চেক (Cheque) হচ্ছে লিখিত এবং প্রস্তুতকারী কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি দলিল যাতে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংকের উপর নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তার নির্দেশে অথবা এর বাহককে চাহিবামাত্র পরিশোধের শর্তহীন নির্দেশ থাকে , এক কথায়- চেক হলো একটি লিখিত নথি , যার মাধ্যমে ব্যাংকে জমা টাকা কাউকে প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এটি ব্যাংকিং লেনদেনের একটি নিরাপদ মাধ্যম। চেকের প্রধান অংশগুলো হলো চেকদাতার নাম ,টাকা প্রদানের পরিমাণ, প্রাপকের নাম, তারিখ ও স্বাক্ষর । (The Economic Times, 2025)
যখন একজন গ্রাহক ব্যাংকের নগদ কাউন্টারে একটি চেক উপস্থাপন করেন, তখন ব্যাংকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, যাতে জালিয়াতি বা ভুল লেনদেন এড়ানো যায়। নিচে ব্যাংকারের গ্রহণযোগ্য সতর্কতাগুলো ব্যাখ্যা করা হলো :
- চেকটি তারিখের দিক থেকে অগ্রিম (post-dated) বা মেয়াদোত্তীর্ণ (stale-dated) কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। চেক মেয়াদোর্ত্তীণ হলে (সরকারী চেক ৩ (তিন) মাস ও সাধারণ চেক ছয় (৬) মাস) ।
- চেকটি তারিখবিহীন কিনা তা যাচাই করতে হবে।
- চেকের মধ্যে সরবরাহকৃত ব্যাংক শাখার নাম আছে কি না তা লক্ষ্য করতে হবে।
- চেকটি দুমড়ানো, মোচড়ানো অথবা ছেঁড়া কি না- এ ধরণের চেক পরিশোধ হবে না ।
- চেকে আদেষ্টার স্বাক্ষর আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে।
- চেকের কোন লেখা মোছা অথবা কাটা, ছেঁড়া কি না । চেকে লেখার যে কোন বিষয়ের পরিবর্তন আদেষ্টার স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে ।
- চেকের উল্লেখিত টাকা কথা ও অংকে লিখিত পরিমাণের গড়মিল হলে তা পরিশোধ করা যাবে না।
- চেকটি কি ধরণের । ক্রসিং যুক্ত চেক কাউন্টারে পরিশোধ করা যাবে না । বাহক বা আদেশ চেক কাউন্টারে নগদ পরিশোধ করা যাবে । তবে অর্ডার চেকের ক্ষেত্রে প্রাপকের পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
- চেকে হিসাব নম্বর না থাকলে টাকা পরিশোধ করা যাবে না।
- আদেষ্টার হিসাবে চেক পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত স্থিতি (অর্থ) আছে কি না অথবা জমাতিরিক্ত ঋণ মঞ্জুর থাকলে চেকটি ঐ অনুমোদিত ঋণের মধ্যে পরিশোধ করা যাবে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে।
- গ্রাহকের মৃত্যুবরণ বা মস্তিষ্ক বিকৃত বা দেওলিয়া হলে চেকের টাকা পরিশোধ করা যাবে না।
- গ্রাহককে সরবরাহকৃত ছাপানো চেকের পাতার চেকটি লিখিত হতে হবে । এজন্য গ্রাহককে ইস্যুকৃত লেজারে লিপিবদ্ধ চেক নম্বরের সাথে উক্ত চেকের নম্বর মিলাতে হবে ।
- গ্রাহক আদেষ্টা কর্তৃক কোন সঙ্গত কারণে চেকের টাকা প্রদান না করার (Stop Payment) নির্দেশ থাকলে।
- যে ব্যক্তি চেকটি নগদায়নের জন্য এসেছে, তার জাতীয় পরিচয়পত্র/চিহ্নিতকরণ দলিল দেখে নিশ্চিত হতে হবে যে সে প্রকৃত ধারক কিনা।
- চেকটি নির্দিষ্ট হিসাবে যথারীতি বিকলন (Debt) করা, হয়েছে কি না । ডেবিটের প্রমাণস্বরূপ চেকের উপর পোষ্টিং মার্কসহ লেজার কিপারের স্বাক্ষর থাকতে হবে ।
- সংশ্লিষ্ট হিসাব বিপরীতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে চেক পরিশোধ করা যাবে না।
- চেকটিতে আদেষ্টার স্বাক্ষর আছে কিনা এবং সেই স্বাক্ষরটি ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের সাথে মিল আছে কিনা
- যদি বড় অঙ্কের চেক হয়, তাহলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হতে পারে।
- দায়িত্বপাপ্ত কর্মকর্তাগণ কর্তৃক চেকটি পরিশোধের নিমিত্তে অবশ্যই নিজ স্বাক্ষরে বাতিল (Cancel) করতে হবে । (Agrani Bank Limited, 2016)
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের চেক :
চেক ব্যাংকিং খাতে একটি অপরিহার্য আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চেক ব্যবহার করে নগদ অর্থ ছাড়াই নিরাপদ ও সহজ উপায়ে লেনদেন সম্পন্ন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করতে পারে। দেশে বহুল ব্যবহৃত চেকের মধ্যে বেয়ারার চেক, অর্ডার চেক, ক্রসড চেক, অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক, ট্রাভেলার্স চেকসহ আরও বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। (Hdfcbank , 2025)
ওপেন বা বেয়ারার চেক (Open / Bearer Cheque) :
বেয়ারার চেক হলো এমন এক ধরনের চেক, যেখানে প্রদানকারী ব্যাংক নির্দিষ্ট কোনো প্রাপকের নাম উল্লেখ না করেই ইস্যু করে। এর অর্থ শুধুমাত্র চেক বহনকারী (Bearer) ব্যাংক থেকে তুলতে পারেন। এটি কার্যত নগদ অর্থের মতো বিবেচিত হয় এবং হারিয়ে গেলে যে কেউ এর সুবিধা নিতে পারে। এজন্য এটি অন্যান্য চেকের তুলনায় কম নিরাপদ। (Hdfcbank , 2025)
অর্ডার চেক (Order Cheque):
অর্ডার চেক এমন এক ধরনের চেক, যেখানে প্রাপকের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে এবং কেবল সেই ব্যক্তি বা তার অনুমোদিত প্রতিনিধি ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে পারেন। এতে “বা বাহক” (or Bearer) শব্দটি কেটে দেওয়া হয়, যা একে বেয়ারার চেকের থেকে পৃথক করে। এই কারণে এটি তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ। (Hdfcbank , 2025)
ক্রসড চেক (Crossed Cheque) :
ক্রসড চেকের উপরে দুটি সমান্তরাল দাগ থাকে, যা বোঝায় যে এর অর্থ সরাসরি নগদে তোলা যাবে না। এটি কেবল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার মাধ্যমেই ভোগ করা সম্ভব। এ ধরনের চেক আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ, কারণ চুরি বা হারিয়ে গেলেও অন্য কেউ নগদ অর্থ তুলতে সক্ষম নয়। (Agrani Bank Limited, 2016)
একাউন্ট পে-ই চেক (Account Payee Cheque) :
এ ধরনের চেকে “অ্যাকাউন্ট পেয়ি” উল্লেখ থাকে, যা নির্দেশ করে চেকের অর্থ কেবল নির্দিষ্ট প্রাপকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই জমা হবে। এটি ক্রসড চেকের একটি বিশেষ ধরণ এবং খুবই নিরাপদ।
ট্রাভেলার্স চেক (Traveller’s Cheque) :
আন্তর্জাতিক ভ্রমণে ট্রাভেলার্স চেক একটি নিরাপদ অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি। এটি মূলত প্রি-পেইড চেক হিসেবে কার্যকর, যার মাধ্যমে ভ্রমণের সময় নগদ টাকা রাখার অসুবিধা এড়ানো যায়। চেকটি হারানো বা চুরি হয়ে গেলেও পুনরায় ইস্যু করা সম্ভব বলে ভ্রমণকারীরা নিরাপদে এটি ব্যবহার করতে পারেন।
পোস্ট-ডেটেড চেক (Post-Dated Cheque, PDC) :
এ ধরনের চেক ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট তারিখে ইস্যু করা হয় এবং ব্যাংক কেবল ওই তারিখে বা তার পর থেকে (যদি মেয়াদ এখনো বৈধ থাকে) অর্থ পরিশোধ করে।
অ্যান্টি-ডেটেড চেক (Ante-Dated Cheque) :
চেকে উল্লেখিত তারিখ অনেক সময় অকার্যকর হতে পারে—যেমন উপস্থাপনের সময়ের আগের কোনো তারিখ হলে। তবে চেকের মেয়াদ (সাধারণত ৬ মাস) শেষ না হলে সেটি দিয়ে বৈধভাবে অর্থ গ্রহণ করা সম্ভব।
‘Stale’ বা মেয়াদ উত্তীর্ণ চেক :
চেক ইস্যুর তারিখ থেকে সাধারণত ৩ থেকে ৬ মাস পর উপস্থাপন করা হলে সেটি ‘Stale’ বা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে ধরা হয়। নির্ধারিত এই সময় অতিক্রম করলে ব্যাংক আর অর্থ প্রদান করে না।
মিউটিলেটেড চেক (Mutilated Cheque):
চেক ছেঁড়া, কেটে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংক সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এবং সঠিকভাবে ইস্যুকারীর নিশ্চয়তা না থাকায় তা গ্রহণ করে না, অথবা ইস্যুকারীর নিশ্চিতকরণ চায়।
সেলফ চেক (Self Cheque):
এই ধরনের চেকে “self” শব্দটি উল্লেখ থাকে এবং এটি মূলত চেক ইস্যুকারী নিজে তাঁর ব্যাংক শাখা থেকে নিজের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে নগদ অর্থ তোলার জন্য ব্যবহার করেন।
ব্যাংকার্স বা ব্যাংকারের চেক (Banker’s Cheque / Bank Draft) :
এই ধরনের চেক সরাসরি ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু করা হয় এবং ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়। প্রেরকের হিসাব থেকে অর্থ আগে থেকেই কেটে নেওয়া থাকে বলে এটি সাধারণত ব্যাংকের গ্যারান্টি হিসেবে ধরা হয়।
অনলাইন/ইলেকট্রনিক চেক প্রসেসিং :
২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে MICR (Magnetic Ink Character Recognition) চেক চালু করা হয়, যা স্বয়ংক্রিয় ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। এতে চেক ইমেজিং ও ট্রাঙ্কেশন প্রযুক্তি (BACPS) ব্যবহার করা হয়। এখানে “High Value” (৫ লাখ টাকা বা তার বেশি) এবং “Regular Value” চেক ভিন্ন ভিন্ন সময়সীমায় নিষ্পত্তি করা হয়। (scribd, 2025)
সামগ্রিক মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিকতা:
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চেক ভিন্ন মাত্রার নিরাপত্তা ও সুবিধা প্রদান করে। বেয়ারার চেক তাৎক্ষণিক লেনদেনের জন্য সুবিধাজনক হলেও, ক্রসড বা অ্যাকাউন্ট পেবী চেক তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে ই-চেকের ব্যবহারও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সঠিক ধরনের চেক নির্বাচন করলে লেনদেন আরও নিরাপদ ও সুবিধাজনক হয়।
References
Agrani Bank Limited. (2016). Reading on Materials on Foundation course for probationary officers. Dhaka: HR Training , Research & development Division.
Hdfcbank . (2025, August 16th). Hdfcbank. Retrieved from Hdfcbank: https://www.hdfcbank.com/personal/resources/learning-centre/save/different-types-of-cheque-you-need-to-know
scribd. (2025, August 16th). E-Cheque (MICR Cheque) in Bangladesh Back Ground. Retrieved from scribd: https://www.scribd.com/document/476366239/MICR-Cheque
The Economic Times. (2025, August 16th). What is ‘Check’. Retrieved from The Economic Times: https://economictimes.indiatimes.com/definition/check?from=mdr

